চম্পুকাব্য
চম্পু বা চম্পুকাব্য (সংস্কৃত: चम्पू) হলো একটি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যধারা, যেখানে গদ্য ও পদ্যের সমন্বয়ে রচনা তৈরি হয়।[১][২][৩] চম্পু শব্দের মূলার্থ হল ‘মিশ্রণ’, যা এই সাহিত্যের প্রকৃতি প্রকাশ করে। চম্পুকাব্য গদ্য ও পদ্যের ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে লেখা হয় এবং এটি সাধারণত মহাকাব্য বা পূরাণ ভিত্তিক কাহিনীগুলোকে তুলে ধরতে ব্যবহৃত হতো। একটি চম্পুকাব্য গদ্য (গদ্য-কাব্য) এবং পদ্যের(পদ্য-কাব্য) সংমিশ্রণে গঠিত, গদ্য বিভাগের মধ্যে বিভিন্ন ছড়া ও শ্লোক ছড়িয়ে থাকে।[৪]
বিশ্বনাথ কবিরাজের প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী- ❝গদ্যপদ্যময়ী ক্বচিৎ চম্পুরিত্যভিধীয়তে।❞[৫] পুরো বাক্যাংশের অর্থ দাঁড়ায়: "যে রচনা গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে তৈরি, তাকে মাঝে মাঝে চম্পু বলা হয়।"
উৎপত্তি
সম্পাদনাইতিহাস
সম্পাদনাআলংকারিক দণ্ডী (খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দী) তাঁর কাব্যাদর্শ নামে কাব্যতত্ত্ব বিষয়ক একটি সারপুস্তিকায় চম্পুকাব্যের উল্লেখ করেন। এ থেকে অনুমান করা যায়, খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্বেও চম্পুকাব্য বিদ্যমান ছিল এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী বেশ কিছু চম্পুকাব্য লিখা হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক বাংলা সাহিত্যে চম্পুকাব্যের তেমন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনা১. গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণ: চম্পুকাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটি গদ্য ও পদ্যের সমন্বয়ে রচিত। গদ্যাংশ সাধারণত বর্ণনামূলক বা বর্ণনাত্মক, যেখানে পদ্যাংশ আবেগময় বা বর্ণনার বিশেষ অংশ প্রকাশে ব্যবহৃত হয়।
২. কাব্যিক সৌন্দর্য: চম্পুকাব্যের পদ্যাংশগুলি সাধারণত সুশৃঙ্খল ছন্দে রচিত, যা শৃঙ্গার (রোমান্স), বীর (বীরত্ব) এবং করুণা (দুঃখ) রস প্রকাশ করে। পদ্যাংশে প্রায়শই সংস্কৃত ছন্দ ব্যবহার করা হয়, যেমন শ্লোক, অনুষ্টুপ, ইত্যাদি।[৬]
৩. কথোপকথনের মাধুর্য: চম্পুকাব্যের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল গদ্য ও পদ্যের মাধ্যমে কথোপকথন এবং বর্ণনার সামঞ্জস্যপূর্ণ মেলবন্ধন। এটি পাঠককে কাহিনীর ভেতরে নিয়ে যাওয়ার একটি নান্দনিক মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
৪. গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও চরিত্রের বর্ণনা: চম্পুকাব্যে প্রধানত মহাকাব্য বা পুরাণের বীরগাথা ও দেবতাদের কাহিনী বর্ণনা করা হয়। এতে মূলত কোনও নায়ক বা দেবতা কেন্দ্রিক ঘটনা প্রবাহের মিশ্রণ দেখা যায়।
৫. পাঠের সহজতা: গদ্য ও পদ্যের পর্যায়ক্রমিক মিশ্রণে রচনাটি সহজে পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে। গদ্য অংশগুলি বর্ণনায় বিশদ, যেখানে পদ্য অংশগুলি আবেগের চরম প্রকাশ ঘটায়, ফলে রচনা পাঠককে আকর্ষিত করে।
৬. ঐতিহাসিক এবং পৌরাণিক প্রেক্ষাপট: বেশিরভাগ চম্পুকাব্যই রচিত হয় পৌরাণিক কাহিনী বা ঐতিহাসিক ঘটনার উপর ভিত্তি করে। উদাহরণ হিসেবে মহাভারত, রামায়ণ, হরিবংশ ইত্যাদি চম্পুকাব্যে রূপান্তরিত হয়েছে।[৭]
উল্লেখযোগ্য চম্পুকাব্য:
সম্পাদনা- ভোজদেবের চম্পূরামায়ণ: এই চম্পুকাব্য রামায়ণের কাহিনী অবলম্বনে লেখা হয়েছে এবং এতে গদ্য ও পদ্যের চমৎকার সংমিশ্রণ দেখা যায়।
- আনন্দরামের ‘নারায়ণীয়’: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ চম্পুকাব্য, যা ভগবান বিষ্ণুর মহিমা গদ্য ও পদ্যের মাধ্যমে বর্ণনা করে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ভট্টাচার্য, কালীপ্রসন্ন (১৯৬৭)। ভারতীয় সাহিত্যে চম্পুকাব্যের ঐতিহ্য। প্রাচীন সাহিত্য প্রকাশন।
- ↑ শর্মা, গিরিধারী (১৯৯৫)। "চম্পু: ভারতীয় সাহিত্যের এক অনন্য রীতি"। সংস্কৃত পত্রিকা। ১২ (৩): ৪৫–৫৮।
- ↑ শাস্ত্রী, রঘুনাথ। "চম্পুকাব্যের ইতিহাস ও এর বৈশিষ্ট্য"। সংস্কৃত সাহিত্য.কম। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০২৪।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ সীতারাম, বি.এন. (১৯৭৬)। চম্পু সাহিত্য: ভারতীয় সাহিত্যের মিশ্র মাধ্যম। সংস্কৃত সাহিত্য বিশ্লেষণ।
- ↑ কবিরাজ, বিশ্বনাথ। সাহিত্যদর্পণ।
- ↑ দাসগুপ্ত, সুরেশচন্দ্র (১৯৮৪)। ভারতীয় কাব্যতত্ত্বের ইতিহাস। সাহিত্য প্রকাশন।
- ↑ "চম্পু"। সংস্কৃত বিশ্বকোষ। ৩। ভারতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র। ২০০৫।
- সাহিত্য দর্পণ বই( sanskrit) (৬/৩৫) - বিশ্বনাথ কবিরাজ
- কাব্যাদর্শ (১/৩)- দণ্ডী