হরমোন

রাসায়নিক বার্তা বাহক

হরমোন (ইংরেজি: Hormone, গ্রিক: ὁρμή) বা প্রাণরস এক ধরনের জৈব-রাসায়নিক তরল যা শরীরের কোনো কোষ বা গ্রন্থি থেকে শরীরের একটি নির্দিষ্ট অংশে নিঃসরিত হয়ে রক্তরস বা ব্যাপন প্রক্রিয়ায় উৎপত্তিস্থল থেকে দূরে বাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন বিপাকীয় ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্রিয়ার পর ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।[] হরমোন কথার অর্থ হল 'জাগ্রত করা'বা 'উত্তেজিত করা'।

বামে: পূর্নবয়স্ক নারীর শরীরে হরমোনের ক্রিয়া (১) ফলিকল-স্টিমুলেটিং হরমোন, (২) লুটেনাইজিং হরমোন, (3) প্রোজেস্টেরন, (4) ইসট্রোজেন। ডানে: পাতা থেকে শিকড়ের এরাবিডোসিস থালিয়ানায় অক্সিন পরিবাহিত হচ্ছে

প্রাণী ও উদ্ভিদের সঠিক বৃদ্ধির জন্য হরমোনের প্রয়োজন রয়েছে। উৎপাদিত জায়গা হতে পরিবাহিত হয়ে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে হরমোন। যে সমস্ত পদার্থকে হরমোন হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তার মধ্যে রয়েছে স্টেরয়েড জাতীয় যেমন ইস্ট্রোজেন, অ্যামাইনো অ্যাসিড যেমন অক্সিন, আইকোসানয়েড জাতীয় যেমন প্রোস্টাগ্ল‍্যান্ডিন, প্রোটিন জাতীয় যেমন ইনসুলিন এবং গ্যাস জাতীয় যেমন ইথিলিন।

শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও কোষের মধ্যে যোগাযোগ করে হরমোন। শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া এবং আচরণিক কাজ যেমন পরিপাক, শ্বাস প্রশ্বাস, ঘুম, দৈহিক বৃদ্ধি, চলাফেরা, প্রজনন ইত্যাদি কাজে হরমোনের ব্যপক ভূমিকা রয়েছে।[][] গাছের মধ্যে হরমোন ব্যপক ক্রিয়া করে থাকে প্রায় সব রকমের বৃদ্ধি থেকে শুরু করে রোগ প্রতিরোধ এবং বয়োবৃদ্ধ হওয়া[]

কোষীয় কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে হরমোন বিশেষ রিসেপ্টর প্রোটিনসহকারে প্রেরণ করে ফলে কোষের সাথে মিশে তা কোষের কার্যক্রম পরিবর্তন করে। এটি কোষের সাথে মেশার ফলে সংকেত পাঠায় জিনে যা থেকে জিন বুঝতে পারে কোন প্রোটিনগুলো বাড়াতে হবে। হরমোন দ্রুত, জিনগত নয় এমন পদ্ধতিতেও কাজ করে থাকে যার ফলে জিনের সাথে সমন্বয় সাধিত হয়।[] জলে দ্রবীভূত হরমোন যেমন পেপটাইড সাধারণত কোষের উপরিভাগে কাজ করে সেকেন্ড মেসেনজার হিসেবে। লিপিড দ্রবীভূত যেমন স্টেরয়েড সাধারণত কোষের প্লাজমা মেমব্রেন ভেদ করে নিউক্লিয়াসের সাথে কাজ করে। এক্ষেত্রে গাছের পাওয়া যায় এমন একটি হরমোন যার নাম ব্রাসিনোস্টেরয়েড হল ব্যতিক্রম যেটি লিপিড দ্রবীভূত হয়েও কোষের উপরিভাগে কাজ করে।[]

মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে এন্ডোক্রিন গ্রন্থি বা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হল বিশেষায়িত প্রত্যঙ্গ যা এন্ডোক্রিন সংকেত বহন ব্যবস্থায় হরমোন নিঃসরণ করে থাকে। "এন্ডোক্রিন" মানে হল রক্তে যা সরাসরি মিশে যায়। বেশিরভাগ হরমোনই নিঃসৃত হয় এন্ডোক্রিন গ্রন্থি থেকে।.এর বিপরীত হল "এক্সোক্রিন" বা বহিঃক্ষরা, এই হরমোন নিঃসৃত হয় শরীর মধ্যস্থ বিভিন্ন নালী এবং ডাক্ট দিয়ে। এক্সোক্রিন গ্রন্থি হতে উৎপাদিত কিছু হরমোন শরীরের বাইরে নিঃসৃত হয় যেমন ঘর্মগ্রন্থি, লালাগ্রন্থি, স্তন্যগ্রন্থি ইত্যাদি।

হরমোন প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯০২ সালে। সেটি ছিল সিক্রেটিন হরমোন। ১৯০৫ সালে হরমোন শব্দটি ব্যবহৃত হয়।[] গ্রীক শব্দ "Hormaein" থেকে হরমোন (Hormone) শব্দটি এসেছে। "Hormaein এর অর্থ উত্তেজিত করা (to excite)।

১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দে বেলিস ও স্টারলিং (Bayliss and Starling 1905) --- সর্বপ্রথম "হরমোন" শব্দটি প্রয়োগ করেন।

জীবদেহের বিভিন্ন রকম বিপাক ক্রিয়ার মধ্যে রাসায়নিক সমন্বয় (Chemical co- ordination) ঘটাতে হরমোন সাহায্য করে। উৎপত্তিস্থল থেকে দূরবর্তী এলাকায় পরিবাহিত হয়ে হরমোন তার কার্যকারিতা দেখায়। এজন্য হরমোনকে রাসায়নিক দূত (Chemical Messenger) বলা হয়। []

হরমোনের বৈশিষ্ট্য

সম্পাদনা
  1. হরমোন একরকম জটিল জৈব পদার্থ।
  2. হরমোন জীবদেহের নির্দিষ্ট কলা বা গ্রন্থিতে সংশ্লেষিত বা নিঃসৃত হয়।
  3. উৎপত্তিস্থান থেকে হরমোন দূরে পরিবাহিত হয়।
  4. অধিকাংশ হরমোন জলে দ্রবণীয় তাই সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে পরিবাহিত হতে পারে।
  5. স্বল্পমাত্রার হরমোন নির্দিষ্ট জৈব পদ্ধতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
  6. একই কলা বা গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন রকম হরমোন নিঃসৃত হতে পারে।
  7. জীবের বিপাকক্রিয়ার মধ্যে হরমোন সমন্বয় সাধন করে।
  8. হরমোনের কার্যকারিতা মন্থর কিন্তু প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়।
  9. হরমোন জীবদেহে ভবিষ্যৎ-এর জন্য জমা থাকে না।
  10. নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদিত হয়ে গেলে হরমোন বিনষ্ট হয়। তাই হরমোনের সংশ্লেষ এবং সরবরাহ খুবই জরুরী।[]

সূচনা এবং সারাংশ

সম্পাদনা

হরমোনের সংকেত প্রেরণ ও গ্রহণ ব্যবস্থায় নিম্নোক্ত ধাপগুলো দেখা যায়:[১০]

  1. একটি বিশেষ জৈববিশ্লেষণ হয় একটি বিশেষ কোষে (হরমোনের জন্য)
  2. সংরক্ষণ এবং নিঃসরণ হয়
  3. যে কোষের জন্য হরমোনটি তৈরি হয়েছে তা পরিবাহিত হওয়া
  4. সম্পর্কিত কোষের মেমব্রেন বা আন্তঃকোষীয় গ্রহণকারক প্রোটিন ব্যবস্থায় হরমোনটিকে চিহ্ণিত করা
  5. কোষীয় সংকেত পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রহণকৃত হরমোন রিলে এবং এম্প্লিফাই করা হয়। এই ব্যবস্থায় কোষীয় সাড়া জাগায়। তখন মূল কোষটি প্রেরিত সংকেত যে কোষকে পাঠানো হয়েছে তা গ্রহণ করেছে কিনা তা বুঝতে পারে। যার ফলে মূল কোষে হরমোনের উৎপাদন কমে যায়। এই ব্যবস্থা হল হোমিওস্টেটিক নেগেটিভ ফিডব্য্যক লুপের একটি উদাহরণ।
  6. সর্বশেষ ধাপে হরমোনটি ভেঙ্গে জৈব যোগে পরিবর্তিত হয়

হরমোন উৎপাদন করে এমন কোষগুলো হল বিশেষ কোষ যেগুলো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতে থাকে যেমন থাইরয়েড গ্রন্থি, জরায়ু এবং টেস্টিস। হরমোন তাদের উৎপাদিত কোষ হতে এক্সিসাইটোসিস ব্যবস্থা বা অন্য কোষীয় মেমব্রেন পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবাহিত হয়। প্রক্রিয়াটি খুবই সাধারণ হরমোন সংকেত প্রেরণ ব্যবস্থার সারসংক্ষেপ। নির্দিষ্ট হরমোন যে কোষ গ্রহণ করে তা বিভিন্ন টিস্যুতে অবস্থিত বিভিন্ন প্রকারের কোষ হতে পারে যেমন ইনসুলিন যেটি নানা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। একই হরমোনের প্রতি বিভিন্ন টিস্যু বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে।

 
এপিনেফ্রাইন (অ্যাড্রেনালিন), একটি ক্যানকোলামিন ধরনের হরমোন

উদ্ভিদ হরমোন

সম্পাদনা

উদ্ভিদের কাণ্ড ও মূলের অগ্রভাবে উপস্থিত ভাজক কলার কোষগুলি উদ্ভিদ হরমোনের অন্যতম প্রধান উৎসস্থল৷ এছাড়া বীজপত্র, মুকুলিত কচি পাতা, ভ্রূণমূল, বর্ধনশীল পাতার কোষ থেকেও হরমোন ক্ষরিত হয়।

উদ্ভিদ হরমোন উদ্ভিদের কোষে রাসায়নিক সমম্বয় সাধন এবং বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এটি উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও কোষবিভাজন নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ফুলের উৎপত্তি ও পরিস্ফুটন,পরিণতি এবং যৌন বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সহায়তা করে।

মানবদেহে হরমোনের প্রভাব

সম্পাদনা

হরমোন আমাদের দেহে নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ মধ্যে রাসায়নিক সংযোগ স্থাপনের কাজ করে। মানব দেহে হরমোনের নিম্নোক্ত প্রভাব দেখা যায়:[১১]

  • দেহের বৃদ্ধি
  • ঘুম-জাগরণের চক্র এবং অন্যান্য সার্কেডিয় ছন্দ সম্পন্ন করে (রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণ, হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বজায় রাখা ইত্যাদি)
  • মুড সুইং - মেজাজের ছন্দপতন, বিভিন্ন আবেগের নিয়ন্ত্রণ
  • এপপটোসিস (কোষের মৃত্যুব্যবস্থা) প্রবর্তন বা ধ্বংসকরণ
  • রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা চালু এবং বন্ধ করা
  • বিপাকীয় কার্য সম্পাদন
  • প্রজনন, যুদ্ধ/আক্রমণ, পলায়ন এবং অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য শরীরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করা
  • শরীরকে জৈবিক নতুন ধাপের জন্য তৈরী করা যেমন বয়ঃসন্ধি, সন্তান লালন-পালন এবং মেয়েদের রজঃস্রাব
  • প্রজননের ধারা নিয়ন্ত্রণ এবং তৈরী করা
  • ক্ষুধা তৈরী ও খাদ্য হজম
  • শরীরকে মারাত্মক ক্ষতি থেকে রক্ষা যেমন ঘাম তৈরি, অজ্ঞান হয়ে পড়া।

একটি হরমোন অন্যান্য হরমোনকে নিঃসৃত ও উৎপাদন করার বিষয়টিও নিয়ন্ত্রণ করে। শরীর মধ্যস্থ অভ্যন্তরীন কার্যপরিবেশ হরমোন সংকেত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, যাকে হোমিওস্টেসিস বলে।

সংকেতের প্রকারভেদ

সম্পাদনা

হরমোন কোথায় নিঃসৃত হচ্ছে তার উপর হরমোনের কাজ নির্ধারিত হয়, কারণ তারা বিভিন্নভাবে নিঃসৃত হয়।[১২] সব হরমোনই একটি কোষ থেকে নিঃসৃত হয় না এবং রক্তেও মিশে না যদি না এর কোন নির্দিষ্ট গ্রহণকারী থাকে। প্রধান হরমোন সংকেতগুলো হল:

সংকেতের প্রকারভেদ - হরমোন
নং প্রকার বিবরণ
অন্তঃক্ষরা রক্তে নিঃসৃত হবার পর সুনির্দিষ্ট কোষে কাজ করে
প্যারাক্রিন নিকটবর্তী কোষে কাজ করে এবং রক্ত পরিবহন ব্যবস্থায় প্রবেশের প্রয়োজন হয় না
অটোক্রিন যে কোষ থেকে নিঃসৃত হয় তাকেই প্রভাবিত করে এবং জৈবিক পরিবর্তন সাধিত করে
ইন্ট্রাক্রিন যে কোষ থেকে সংশ্লেষণ হয় তাদের মধ্যেই আন্তঃকোষীয় কাজ করে

বিভিন্ন হরমোনের পুরো নাম

সম্পাদনা
  • TRH- Thyrotropin Releasing Hormone
  • CRH - Corticotropin Releasing Hormone
  • SRH - Somatotropin Releasing Hormone
  • GH-IH - Growth Hormone Releasing Hormone
  • GnRH - Gonadotropin Releasing Hormone
  • PRH - Prolactin Realising Hormone
  • PIH - Prolactin Inhibiting Hormone
  • MSH-RF - Melanocyte Stimulating Hormone-Releasing Factor
  • MSH-RIF - Melanocyte Stimulating Hormone-Release Inhibiting Factor
  • MSH- Melanocyte Stimulating Hormone
  • TSH - Thyroid Stimulating Hormone
  • ACTH - Adrenocorticotropic Hormone
  • GH - Growth Hormone
  • STH - Somatotropic Hormone
  • GTH - Gonadotropic Hormone
  • FSH - Folicol Stimulating Hormone
  • LH - Leutinising Hormone
  • ICSH - Interstitial Cell Stimulating Hormone
  • ADH - Antidiuretic Hormone
  • PTH-প্রোথোরাসিকোট্রপিক হরমোন
  • ADH-অ্যাকোডাইসিন হরমোন

অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের হরমোন

সম্পাদনা

নীচুস্তরের অমেরুদণ্ডী প্রাণিদেহে হরমোনের অস্তিত্ব সম্পর্কে সঠিকভাবে এখনো যায়নি। তবে কিছু উঁচু স্তরের অমেরুদন্ডী প্রাণীর দেহে বিভিন্ন রকম হরমোনের সম্পর্কে জানা গেছে।

এই সমস্ত অমেরুদণ্ডী প্রাণীর বিশেষ ধরনের কতকগুলি স্নায়ুকোষ থেকে হরমোন নিঃসৃত হয়। একে স্নায়ুক্ষরণ গ্রন্থি (Neuro-secretory Glands) বলে। এই নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ বা হরমোনকে নিউরোসিক্রিটারী হরমোন (Neurosecretory Hormones or NSH) বলা হয়।

অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হরমোন নিম্নরূপ:

(ক) একডাইসোন হরমোন (Ecdysone Hormone): পতঙ্গ শ্রেণির যেমন, মাছি, মৌমাছি, ফড়িং, প্রজাপতি, রেশম মথ ইত্যাদিতে একডাইসোন হরমোন দেখা যায়। বিভিন্ন পতঙ্গের জীবনচক্রে এই হরমোন খোলস ত্যাগ পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে।

(খ) জুভেনাইল হরমোন (Juvenile Hormone): এই হরমোন পতঙ্গদের জীবনচক্রে লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ দশা পর্যন্ত রূপান্তরে সাহায্য করে।

(গ) ক্রোম্যাটোফোরোট্রপিন হরমোন (Chromatophorotropin Hormone): চিংড়ি ও অন্যান্য কয়েকটি সন্ধিপদী প্রাণীতে এই হরমোন থাকে। চিংড়ির এক্স অঙ্গ বা সাইনাস গ্রন্থি (X-organ or Sinus Gland) থেকে এই হরমোন নিঃসৃত এবং রক্ত কর্তৃক বাহিত হয়ে বিভিন্ন স্থানে যায়। এই হরমোনের প্রভাবে রঙ্গক কোষ (Pigment Cells) তার রঙ পরিবর্তন করে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ায়। এজন্য প্রাণীর দেহের রঙে পরিবর্তন আসে।[১৩]

মানবদেহের হরমোন

সম্পাদনা

মানুষের শরীরে হরমোন প্রধানত বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। রক্ত মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে কোন নির্দিষ্ট অঙ্গ বা গ্রন্থিতে যায় এবং কাজ করে। মানুষের বিভিন্ন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন ও তাদের কাজ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হল।

পিটুইটারী গ্রন্থি (Pituitary Gland): আমাদের মস্তিষ্কের নীচে দুটি দৃক্ স্নায়ুর (Optic Nerve) নির্গমন পথের পিছনে অবস্থিত। গড় ওজন মাত্র ০.৫ গ্রাম। গ্রন্থিটি দেখতে ছোট মটর দানার মতো, কিন্তু কার্যকলাপ বিরাট। এই গ্রন্থির দ্বারা দেহের অন্যান্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির কাজও নিয়ন্ত্রিত হয় বলে একে মাস্টার গ্ল্যাণ্ড বা প্রভু-গ্রন্থি বলা হয়। একে দু'ভাগে ভাগ করা যায়:

(ক) সম্মুখস্থ পিটুইটারী: এটি প্রকৃত পক্ষে গ্ৰন্থিময় অংশ। এখান থেকে বৃদ্ধি পোষক হরমোন বা সোমাটৌট্রফিক হরমোন (Somato Trophic Hormone or S.T.H.). থাইরয়েড উদ্দীপক হরমোন (Thyroid Stimulating Hormone or T.S.H. অ্যাডরেনো করটিকোট্রফিক হরমোন (Adreno Corticotrophic Hormone or A.C.T.H) এবং কিছু কিছু যৌন গ্ৰন্থি পোষক হরমোন (Gonadotrophic Hormonesor G.T.H.) ক্ষরিত হয়। সম্মুখস্থ পিটুইটারী দেহের বৃদ্ধি, অন্যান্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ও প্রজননতন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে।

(খ) পশ্চাৎ-পিটুইটারী: এটিকে স্নায়ুজ পিটুইটারী বলা হয়। এখান থেকে অক্সিটোসিন (Oxytocin) ও ভেসোপ্রেসিন (Vasopressin) হরমোন নিঃসৃত হয়। হরমোনগুলি জরায়ু-সংকোচন, অনৈচ্ছিক পেশী সংকোচন, জলসাম্য রক্ষা প্রভৃতির জন্য দায়ী।

পিটুইটারী থেকে ঠিকমতো হরমোন ক্ষরিত না হলে দেহের, বিশেষত শিশুদেহের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এর ফলে বয়স বাড়লেও দেহ ঠিকভাবে বাড়ে না। একে বামনত্ব (Dwarfism) বলে। বিপরীত দিকে হরমোন ক্ষরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে দেহ অস্বাভাবিক দীর্ঘ হয়ে পড়ে। একে অতিকায়ত্ব (Gigantism) বলে।[১৪]


থাইরয়েড গ্রন্থি (Thyroid gland): শ্বাসনালীর উভয়পাশে একজোড়া লতি সমন্বিত এই গ্রন্থিটি অবস্থিত। শ্বাসনালীর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বলয় পর্যন্ত এটি বিস্তৃত থাকে। একে গলগ্রন্থিও বলে। এব ওজন প্রায় ২৫ থেকে ৪৫ গ্রামের মতো। আয়োডিনকে কাজে লাগিয়ে গ্রন্থিটি থাইরক্সিন (Thyroxin) নামে হরমোন উৎপাদন করে, যা দেহের বিপাকীয় হার নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য অংশ নেয়।

এই গ্রন্থিটি অতিরিক্ত ক্রিয়াশীল হলে, দেহের ওজন কমে, স্নায়বিক দুর্বলতা দেখা যায় ও আকারে বেড়ে গিয়ে গলগণ্ডের সৃষ্টি করে। ঐ সঙ্গে চোখদুটি ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। একে গ্রোভপীড়া বা সদাবিস্ফারিত নেত্র গলগণ্ড (Grave Disease) বলে।

আবার, থাইরয়েড ঠিকমতো হরমোন ক্ষরণ না করলে দেহের বিপাকক্রিয়া মন্থর হয়ে পড়ে, শ্বাসক্রিয়া ও হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক থাকে না, বৃদ্ধির জড়তা ও দৈহিক মেদবাহুল্য দেখা দেয়। জড়বুদ্ধি শিশুও একই কারণে এইরকম হয়।

প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি (Parathyroid Glands): প্রতিটি থাইরয়েডের পিছন দিকে দুটি কবে মোট চারটি ক্ষুদ্র গোলাকার গ্রন্থি থাকে। এগুলিই প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি। এদের মোট ওজন প্রায়। ১৩৫ মিলিগ্রাম। প্রন্থিগুলি থেকে প্যারাথরমোন (Parathormone) নিঃসৃত হয় যা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের বিপাক নিয়ন্ত্রণে অশে নেয়। ক্যালসিয়াম রক্ত জমাট-বাঁধার পক্ষে অপরিহার্য।

ল্যাংগারহানসের দ্বীপ গ্রন্থি (Islets of Langerhans): অগ্ন্যাশয়ের মধ্যে খুব ছোট ছোট অসংখ্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকোষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের মতো বিস্তৃত থাকে। এগুলিই ল্যাংগারহানসের দ্বীপ গ্রন্থি। বিজ্ঞানী ল্যাংগারহানস (Langerhans) 1869 সালে এই প্রন্থিগুলির বর্ণনা দেওয়ায় তাঁর নামানুসারেই এদের নামকরণ করা হয়েছে। গ্রন্থিগুলি আলফা কোষ ও বিটা-কোষে গঠিত। একজন পূর্ণবয়স্ক লোকের অগ্ন্যাশয়ে মোট প্রায় সাত লক্ষের অধিক এই কোষ থাকে। আলফা-কোষ থেকে গ্লুকাগোন (Glucagon) এবং বিটা-কোষ থেকে ইনসুলিন (Insulin) হরমোন নিঃসৃত হয়। হরমোনগুলি কার্বেহাইড্রেটের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। ইনসুলিন রক্ত শর্করার মাত্রা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে। অপরপক্ষে গ্লুকাগোন রক্ত শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি করে। ইনসুলিন নির্দিষ্ট মাত্রায় ক্ষরিত না হলে রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়ে। এর থেকে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস (Diabetes) রোগের সৃষ্টি হয়।

অ্যাডরেনাল গ্রন্থি (Adrenal Glands):

প্রতিটি কিডনীর সম্মুখস্থ একটি করে মোট দুটি ত্রিকোণাকৃতি গ্রন্থিই অ্যাডরেনাল গ্রন্থি। এক একটির ওজন প্রায় পাঁচ গ্রামের মতো। জন্মলগ্নে বৃহদাকার থাকলেও পক্ষকালের মধ্যে এর ওজন ও আয়তন দুই ই হ্রাস পায়। প্রতিটি গ্রন্থি মোট দুটি পৃথক স্তরে গঠিত। স্তর দুটি যথাক্রমে-

(ক) বহিঃস্তর বা কর্টেক্স (Cortex): বাইরের স্তর দানাদার বা পীতাভ। এখান থেকে কর্টিসোন (Cortisone) নামে হরমোন নিঃসৃত হয়। এই হরমোন কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, স্নেহপদার্থ ইত্যাদির বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া জলসাম্য, ফসফরাসের সংযুক্তি, সোডিয়াম পটাসিয়ামের সাম্য, অ্যান্টিবডি ও প্রদাহ প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে এর বিশেষ কাজ রয়েছে। এই হরমোনের অতিরিক্ত ক্রিয়ায় মহিলার দেহে পুরুষ-লক্ষণ ফুটে ওঠে।

(খ) অন্তঃস্তর বা মেডালা (Medulla): এটি ভিতরের অংশ। এখান থেকে অ্যাডরেনালিন বা এপিনেফ্রিন (Adrenaline or Epinephrine) এবং নর- অ্যাডবেনালিন বা নর-এপিনেফ্রিন (Nor Adrenaline or Nor Epineporine) নামে হরমোন নিঃসৃত হয়। কোনো কারণে ভয় পেলে বা রাগান্বিত হলে, এর নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়। এই হরমোনের প্রভাবে গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। জরুরী অবস্থার মোকাবিলাতে হরমোনগুলি অংশ নেয়, কেননা রক্ত তঞ্চনের কাজ তরান্বিত করা এর অন্যতম কাজ। দুর্ঘটনায় রক্তপাত ঘটলে এই হরমোন ক্ষরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। নর- অ্যাডরেনালিন রক্তনালীর পেশীতন্তুর উপর উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, ফলে নালী সংকুচিত হয় ও রক্তচাপ বাড়ে। সেজন্য একে 'আপদকালীন হরমোন' বলা হয়।

অ্যাডরেনালিন যকৃত থেকে গ্লুকোজ অপসারণেও অংশ নেয়।

থাইমাস্ গ্রন্থি (Thymus Gland): থাইরয়েড গ্রন্থির কিছুটা নীচে একজোড়া লম্বাটে থাইমাস্ গ্রন্থি অবস্থিত। এগুলি শৈশবাবস্থায় বড় থাকে ও পরে এর আকার হ্রাস পায়। যৌবনে যৌবনলক্ষণ প্রকাশ ও জননগ্রন্থি গঠনের কাজ এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

ডিম্বাশয় (Ovary): স্ত্রীদেহের শ্রোণীগহ্বরে জরায়ুর দুপাশে দুটো ডিম্বাশয়ের অবস্থান। ডিম্বাণু উৎপাদন করা ছাড়াও ডিম্বাশয় অন্যতম অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হিসেবে কাজ করে। এখান থেকে (২) এসট্রোজেন, (২) প্রোজেস্টেরন, (৩) রিলাক্সিন, (৪) অ্যানড্রোজেন হরমোন নিঃসৃত হয়। গৌণ যৌন লক্ষণসমূহের (Secondary sexual characters) বিকাশ ও গর্ভকালীন অবস্থা ঠিকমত বজায় রাখা এদের প্রধান কাজ।

গর্ভফুল বা প্ল্যাসেনটা (Placenta): ভ্রূণ জরায়ুতে রোপিত হবার পর প্ল্যাসেনটার সৃষ্টি হয়। প্ল্যাসেনটাই মাতৃদেহ ও ভ্রূণের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম। প্ল্যাসেনটা অন্যতম অস্থায়ী অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি হিসেবেও কাজ করে। এখান থেকে এসট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন রিলাক্সিন ও মঞ্জরীকোষীয় গ্রন্থিপোষক হরমোন নিঃসৃত হয়। গর্ভকালীন অবস্থা বজায় রাখাই এদের মূল লক্ষ্য।

শুক্রাশয় (Testis): পুরুষের জননাঙ্গের অন্তর্গত অণ্ডকোষ বা 'স্ক্রোটাম' নামক থলির মধ্যে দুটো শুক্রাশয়ের অবস্থান। পরিণত পূরুষের শুক্রাশয় শুক্রাণু উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে যৌন হরমোন উৎপন্ন করতেও পারে।

এখান থেকে মূলতঃ টেসটোস্টেরন (Testosterone) হরমোন নিঃসৃত হয়। এটি শুক্রাশয়ের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুরুষের গৌণ যৌন লক্ষণসমূহের বিকাশ ঘটায়।

অপরিণত অবস্থায় শুক্রাশয় অপসারণ করলে মানুষের দেহে গৌণ যৌন লক্ষণ প্রকাশ পায় না ও দেহে প্রচুর চর্বি জমে। এককথায় এতে পুরুষালী ভাব নষ্ট হয়।

অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহের সম্মিলিত ক্রিয়াকলাপ

এখানে পৃথক পৃথকভাবে যেসব অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির কথা বলা হ'ল সেগুলি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ করলেও মনে রাখা প্রয়োজন যে, সেগুলির সম্মিলিত প্রয়াসেই দেহের আভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বা শৃঙ্খলা বজায় থাকে বা সামগ্রিকভাবে আমাদের দেহ তার স্বাভাবিক বিপাকীয় বা অন্যান্য ক্রিয়া চালিয়ে যেতে পারে। এইভাবে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিসমূহের মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ আছে বলেই সমস্ত অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে অন্তঃক্ষরা তন্ত্র (Endocrine System)। [১৫]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Shuster M (২০১৪-০৩-১৪)। Biology for a changing world, with physiology (Second সংস্করণ)। New York, NY। আইএসবিএন 9781464151132ওসিএলসি 884499940 
  2. Neave N (২০০৮)। Hormones and behaviour: a psychological approach। Cambridge: Cambridge Univ. Press। আইএসবিএন 978-0521692014lay summaryProject Muse 
  3. "Hormones"MedlinePlus। U.S. National Library of Medicine। 
  4. "Hormone - The hormones of plants"Encyclopedia Britannica (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০১-০৫ 
  5. Ruhs S, Nolze A, Hübschmann R, Grossmann C (জুলাই ২০১৭)। "30 Years of the Mineralocorticoid Receptor: Nongenomic effects via the mineralocorticoid receptor"। The Journal of Endocrinology234 (1): T107–T124। ডিওআই:10.1530/JOE-16-0659 পিএমআইডি 28348113 
  6. Wang ZY, Seto H, Fujioka S, Yoshida S, Chory J (মার্চ ২০০১)। "BRI1 is a critical component of a plasma-membrane receptor for plant steroids"। Nature410 (6826): 380–3। ডিওআই:10.1038/35066597পিএমআইডি 11268216 
  7. Hirst, BH (২০০৪), "Secretin and the exposition of hormonal control", J Physiol, 560: 339, পিএমআইডি 15308687 
  8. বই উদ্ধৃতি:মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান, লেখক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শিরোনাম:হরমোন, প্রকাশক:শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর:নভেম্বর ১৯৮৬, পৃঃ২৯
  9. বই উদ্ধৃতি: মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান, লেখক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শিরোনাম: হরমোন প্রকাশক:শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর=এপ্রিল ১৯৮৬, পৃঃ২৯
  10. Nussey S, Whitehead S (২০০১)। Endocrinology: an integrated approach। Oxford: Bios Scientific Publ.। আইএসবিএন 978-1-85996-252-7 
  11. Lall S (২০১৩)। Clearopathy। India: Partridge Publishing India। পৃষ্ঠা 1। আইএসবিএন 9781482815887 
  12. Molina PE (২০১৮)। Endocrine physiology। McGraw-Hill Education। আইএসবিএন 9781260019353ওসিএলসি 1034587285 
  13. বই উদ্ধৃতি:মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান, লেখক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শিরোনাম:হরমোন, প্রকাশক:শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর:এপ্রিল ১৯৮৬, পৃঃ ৩৮
  14. বই উদ্ধৃতি:মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান, লেখক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শিরোনাম:হরমোন, প্রকাশক:শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর:এপ্রিল ১৯৮৬, পৃঃ ৪০,৪১
  15. বই উদ্ধৃতি:মাধ্যমিক জীবন বিজ্ঞান, লেখক: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শিরোনাম:হরমোন, প্রকাশক:শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা,বছর:এপ্রিল ১৯৮৬, পৃঃ ৪১,৪২,৪৩

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা

টেমপ্লেট:Signal transduction

  NODES
Project 1