হাইড্রা
হাইড্রা (/ˈhaɪdrə/ HY-drə) নিডারিয়া পর্বের স্বাদুপানিতে থাকা হাইড্রোজোয়া গণ। এদের পাওয়া যায় নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে। জীববিজ্ঞানীরা হাইড্রার প্রতি বিশেষ আগ্রহী এর পুনরুৎপত্তি ক্ষমতার জন্য।
হাইড্রা | |
---|---|
হাইড্রা প্রজাতি | |
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ: | Animalia |
উপজগৎ: | Eumetazoa |
পর্ব: | Cnidaria |
উপপর্ব: | Medusozoa |
শ্রেণী: | Hydrozoa |
উপশ্রেণী: | Leptolinae |
বর্গ: | Anthomedusae |
উপবর্গ: | Capitata |
পরিবার: | Hydridae |
গণ: | Hydra Linnaeus, 1758[১] |
Species[১] | |
তালিকা
|
হাইড্রার প্রকৃত আবিষ্কারক আব্রাহাম ট্রেম্বলে (Abraham Trembley, ১৭১০-১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে)। ক্যারোলাস লিনিয়াস এর নাম দেন হাইড্রা। হাইড্রা একটি বহুমস্তকবিশিষ্ট কাল্পনিক গ্রিক দৈত্যের(ড্রাগন) নাম। দৈত্যের বা ড্রাগনের মাথা কাটলে তার বদলে দুই বা তার বেশি মাথা গজাতো। হাইড্রা ঐ দৈত্যের মতো হারানো বা ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পুনরায় সৃষ্টি করতে পারে, তাই অনেক সময় বহু মাথাওয়ালা সদস্য আবির্ভূত হয়। দেখতে হাইড্রা নামের সেই দৈত্যের মতো।[২]
হাইড্রা মুক্তজীবী। এরা মিঠাপানিতে নিমজ্জিত কঠিন বস্তু এবং জলজ উদ্ভিদের পাতার নিচের তলে সংলগ্ন থেকে নিম্নমুখী হয়ে ঝুলে থাকে। এরা মাংসাশী। কর্ষিকার সাহায্যে খাদ্য গ্রহণ করে। চলাফেরা করে দেহের সংকোচন-প্রসারণও কর্ষিকার সাহায্যে। ব্যাপন প্রক্রিয়ায় শ্বসন ও রেচন সম্পন্ন করে। মুকুলোদগম ও দ্বিবিভাজনের সাহায্যে অযৌন জনন এবং জনন কোষ সৃষ্টি করে যৌন জনন সম্পন্ন হয়। হাইড্রা-র পুনরুৎপত্তি ক্ষমতা প্রচন্ড।[২]
অঙ্গসংস্থান
সম্পাদনাহাইড্রার দেহ নলাকার, অরীয় প্রতিসম, প্রসারিত অবস্থায় দৈর্ঘ্য ১০ মি.মি. (০.৩৯ ইঞ্চি)। দেহের তলে চ্যাপ্টা আঠালো পদ আছে যাকে পদচাকতি বলে। পদচাকতির গ্রন্থি কোষ আঠালো পদার্থ নিঃসরণ করে।
দেহের খোলা প্রান্তে আছে মুখছিদ্র এবং একে ঘিরে থাকে ১-১২টি সরু সচল কর্ষিকা। কর্ষিকার গায়ে থাকে নিডোসাইট কোষ যাতে থাকে বিশেষ থলি নেমাটোসিস্ট। এটি দেখতে বিদ্যুৎ বাল্বের মতো এবং এতে প্যাঁচানো সূত্রক থাকে। নিডোসাইটের সরু প্রান্তে ট্রিগার হিসেবে সংবেদী রোম নিডোসিল থাকে। শিকারের সংস্পর্শে এলে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নেমাটোসিস্ট নিক্ষিপ্ত হয় আর এর ভেতরে থাকা বিষাক্ত তরল হিপনোটক্সিন শিকারকে অবশ করে দেয়।
হাইড্রা দ্বিস্তরী প্রাণী, অর্থাৎ এতে দুটি ভ্রূণীয় স্তর থাকে: এপিডার্মিস ও গ্যাস্ট্রোডার্মিস। স্তর দুটির মধ্যে আছে অকোষীয় জেলির মতো পদার্থ মেসোগ্লিয়া। স্তরদ্বয়ের কোষগুলো তুলনামূলকভাবে সরল।
চলন
সম্পাদনাহাইড্রার দুটি স্বতন্ত্র চলন পদ্ধতি আছে- লুপিং বা হামাগুড়ি এবং সমারসল্টিং বা ডিগবাজি।এদের মধ্যে হামাগুড়ি ধীরে ও somersaulting দ্রুত চলনের ক্ষেত্রে । এসব পদ্ধতিতে হাইড্রা দিনে কয়েক ইঞ্চি (১০০ মি.মি.) এগোতে পারে । এছাড়া হাইড্রা গ্লাইডিং, ভাসা , সাঁতার , হেঁচড়ান , নতমুখী চলন , দেহের সংকোচন প্রসারণ , ক্রমসংকোচন ইত্যাদি ভাবে চলাচল করে।
১.লুপিং(Looping)বা হামাগুড়ি: লম্বা দূরত্ব অতিক্রম এর জন্য হাইড্রা সাধারণত লুপিং চলনের আশ্রয় নেয়। এ প্রক্রিয়ার শুরুতে এক পাশের পেশি আবরণী কোষগুলো সংকুচিত হয় এবং অপর পাশের অনুরূপ কোষগুলো সম্প্রসারিত হয়।ফলে হাইড্রা গতিপথের দিকে দেহকে প্রসারিত করে ও বাঁকিয়ে মৌখিক দলকে ব্যক্তির কাছাকাছি নিয়ে আসে এবং কর্ষিকা গ্লুটিন্যান্ট নেমাটোসিস্ট এর সাহায্যে আটকে ধরে। এরপর পাদ-চাকতিকে মুক্ত করে মুখের কাছাকাছি এনে স্থাপন করে এবং কর্ষিকা বিযুক্ত করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এ পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে হাইড্রা স্থান ত্যাগ করে। জোক বা শুঁয়াপোকা চলার সময় যেভাবে ক্রমান্বয়ে বাসের সৃষ্টি হয় হাইড্রার চলন দেখতে অনেকটা একই রকম হয় ফাঁস চলনকে জোঁকা চলন বা শুয়োপোকা চলন নামে অভিহিত করা যায়। এই পদ্ধতিতে হাইড্রা তার দেহের দৈর্ঘ্যের অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করে।
২.সমারসলটিং(Somersaulting)বা ডিগবাজি: এটি হাইড্রার সাধারণ ও দ্রুত চলন প্রক্রিয়া। স্বল্প দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য হাইডা সাধারণত এ পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। চলনের শুরুতে হাইড্রা দেহকে বাঁকিয়ে চলনের গতিপথে কর্ষিকাস্থিত গ্লুটিন্যান্ট জাতীয় নেমাটোসিস্টের সাহায্যে গতিপথকে স্পর্শ করে, ফলে একটি লুপ বা ফাঁস তৈরি হয়। পরে পাদ-চাকতি বিমুক্ত করে কর্ষিকার উপর ভর দিয়ে দেহকে সোজা করে দেয় এবং পুনরায় দেহকে বাঁকিয়ে পাদ-চাকতির সাহায্যে গতিপথকে স্পর্শ করে, ফলে আরেকটি লুপ তৈরি হয়। এরপর কর্ষিকা মুক্ত করে পাদ- চাকতির উপর ভর করে দেহকে সোজা করে দেয়। বারবার এ প্রক্রিয়া পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে হাইড্রা দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এরূপ চলনে হাইড্রা একবার কর্ষিকার উপর এবং একবার পাদ-চাকতির উপর ভর করে দাঁড়ায় যা পর্যায়ক্রমে চলে, তাই একে ডিগবাজি চলন বলা হয়। এ পদ্ধতিতে প্রতিবার চলনে দুটি লুপ তৈরি হয় এবং হাইড্রা তার দেহের দৈর্ঘ্যের প্রায় দ্বিগুণ দূরত্ব অতিক্রম করে।
প্রজনন এবং জীবনচক্র
সম্পাদনাযখন খাবার থাকে বেশি অর্থাৎ অবস্থা অনুকূল তখন হাইড্রা অযৌন প্রজনন ঘটায়। তার দেহে মুকুল তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে বড় হয় এবং হাইড্রার আকৃতি নেয়। একটু বড় হলে মাতৃ হাইড্রা থেকে অপত্য হাইড্রা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যখন পূর্ণ বয়স্ক হয়, তখন নতুন মুকুল প্রতি দুইদিনে তৈরি হতে পারে।[৩] কিন্তু অবস্থা যখন প্রতিকূল হয়, অথবা খাবার কম হয়, অথবা শীতকালের পূর্বে হাইড্রার যৌন প্রজনন ঘটে। হাইড্রার দেহের কিছু অংশ স্ফীত হয়ে শুক্রাশয় বা ডিম্বাশয় গঠন করে। শুক্রাশয় শুক্রাণু উৎপন্ন করে, এবং শুক্রাণুকে পানিতে ছেড়ে দেয়। সর্বাধিক সক্ষম শুক্রাণুটি ডিম্বাশয়ে অবস্থিত ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে। নিষিক্ত ডিম্বাণুটির চারপাশে একটি শক্ত প্রাচীর গঠিত হয়। এরপর জলাশয়ের নিচে অনুকূল পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করে। এরপর আবরণ ভেদ করে হাইড্রা বের হয়ে আসে এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন অতিবাহিত করে। কিছু কিছু হাইড্রা যেমন Hydra circumcincta এবং Hydra viridissima, হচ্ছে উভলিঙ্গ।[৪] যারা একই সাথে শুক্রাশয় এবং ডিম্বাশয় উভয়ই উৎপাদন করে। Hydrozoa র অনেক সদস্যকে শিশু অবস্থায় পলিপ দশা এবং পরিণত অবস্থায় মেডুসা দশায় দেখা যায়। আবার অনেক হাইড্রায় হাইড্রোজোয়ার সদস্য হওয়া সত্তেও সমগ্র জীবনব্যাপী শুধুমাত্র পলিপ দশা দেখা যায়।
খাদ্যগ্রহণ
সম্পাদনাহাইড্রা প্রধানত জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণী, যেমন ড্যাফনিয়া ও সাইক্লপস খেয়ে জীবনধারণ করে।
হাইড্রার প্রধান খাদ্য 'ক্রাস্টাসীয়' নামক 'Arthropoda' পর্বের প্রাণী। তাছাড়া এরা মাছের ডিম ও পতঙ্গের লার্ভা খেয়ে থাকে।
হাইড্রার কিছু প্রজাতি বিভিন্ন এককোষী শৈবালের সাথে মিথোজীবী হিসেবে অবস্থান করে। হাইড্রা শৈবালকে আশ্রয় দেয়, শিকারী থেকে রক্ষা করে এবং শৈবালের সালোকসংশ্লেষণে তৈরি খাদ্যের উদ্বৃত্ত অংশ গ্রহণ করে।
শিকার:
হাইড্রা মূলত তার বহি:ত্বকের কোষীয় বস্তু নিডোসাইটের সাহায্যে শিকার করে। শিকারের প্রক্রিয়াটি মূলত ২ টি পর্যায়ে ঘটে থাকে। যান্ত্রিক প্রক্রিয়া,অন্যটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া। হাইড্রার নিডোসাইট দেখতে গোল,নাশপাতি আকার বা লাটিম আকৃতির।আদর্শ নিডোসাইটের ক্যাপসুলটি প্রোটিন ও ফেনল এর সমন্বয়ে গঠিত বিষাক্ত তরল হিপনোটক্সিন এ পরিপূর্ণ থাকে। যা তাকে শিকারে সাহায্য করে।
বার্ধক্যহীনতা(চিরযৌবনা)
সম্পাদনা১৯৯৮ সালে প্রকাশিত এক আর্টিকেলে (যার নামExperimental Gerontology) Daniel Martinez দাবি করেন হাইড্রা জৈবিকভাবে অমরণশীল.[৫] এই প্রকাশনায় ব্যাপকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে হাইড্রার বয়স বৃদ্ধি হয় না এবং 'অনন্তযৌবনা জীব' হিসাবে এটি সাধারণভাবে গৃহীত হয়। প্রকাশকের কাছে ২০১০ সালে Preston Estep প্রকাশ করেন একটি চিঠি, যেখানে তিনি বলেন মার্টিনেজের গবেষণা হইড্রার বার্ধক্য হয় একে বাতিল করার বদলে বরং সমর্থন করে।[৬]
হাইড্রার জীবনকাল নির্দিষ্ট না অসীম, এই বিতর্কিত বিষয় গবেষকদের আকর্ষণ করেছে বহু সময় ধরে। কিন্তু আজ গবেষকরা মার্টিনিজের গবেষণাকে পুন:প্রমাণ করে সুনিশ্চিত করেছেন, তিনি সঠিক ছিলেন।[৭] হাইড্রার স্টেম কোষের ক্ষমতা আছে নিজের কোষকে নিজে নিজেই নবায়ন করার। transcription factor, "forkhead box O" (FoxO) কে বিবেচনা করা হয় হাইড্রাকে ক্রমাগত নবীন রাখার জটিল পথপ্রদর্শক হিসাবে।[৭][৭]
হাইড্রার অমরণশীলতা পুরোপুরি সমর্থিত, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এটা সম্ভব কি না তা আজো বিতর্কিত।যদিও এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ব্যাপক উৎসাহ রয়েছে, গবেষণা চলছে,[৭] তারপরেও এ বিষয় বিজ্ঞানীদের পুরোপুরি আত্মস্থ করতে আরো বহুদূর পাড়ি দিতে হবে।মানুষের বার্ধক্য দূরীকরণের জন্য আরো অনেক গবেষণা করতে হবে।[৮]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ Schuchert, P. (২০১১)। P. Schuchert, সম্পাদক। "Hydra Linnaeus, 1758"। World Hydrozoa database। World Register of Marine Species। সংগ্রহের তারিখ ২০১১-১২-২০।
- ↑ ক খ উচ্চমাধ্যমিক জীববিজ্ঞান ২য় পত্র-গাজী আজমল, গাজী আসমত; ৩০,৩১ পৃষ্ঠা
- ↑ Patton, Wendell K. "Hydra (coelenterate)." Grolier Multimedia Encyclopedia. Grolier Online, 2014. Web. 12 Aug. 2014.
- ↑ Holstein, T. (1995) Cnidaria: Hydrozoa Süsswasserfauna von Mitteleuropa. 1/2+ 3. Stuttgart, Jena, NY: Gustav Fisher Verlag.
- ↑ Martinez, D. E. (মে ১৯৯৮)। "Mortality patterns suggest lack of senescence in Hydra" (পিডিএফ)। Experimental Gerontology। 33 (3): 217–225। ডিওআই:10.1016/S0531-5565(97)00113-7। পিএমআইডি 9615920। ১২ মে ২০১৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ ডিসেম্বর ২০১৬।
- ↑ Estep, P. W. (সেপ্টেম্বর ২০১০)। "Declining asexual reproduction is suggestive of senescence in Hydra: comment on Martinez, D., "Mortality patterns suggest lack of senescence in Hydra.""। Experimental Gerontology। 45 (3): 645–6। ডিওআই:10.1016/j.exger.2010.03.017। পিএমআইডি 20398746।
- ↑ ক খ গ ঘ Boehm, Khalturin, Anton-Erxleben, Hemmrich, Klostermeier, Lopez-Quintero, Oberg, Puchert, Rosenstiel, Wittlieb, Bosch; Khalturin; Anton-Erxleben; Hemmrich; Klostermeier; Lopez-Quintero; Oberg; Puchert; Rosenstiel; Wittlieb; Bosch (২০১২)। "FoxO is a critical regulator of stem cell maintenance in immortal Hydra"। Proceedings of the National Academy of Sciences। 109 (48): 19697। ডিওআই:10.1073/pnas.1209714109। বিবকোড:2012PNAS..10919697B।
- ↑ Reason (নভেম্বর ২০১২)। "Investigating the Agelessness of Hydra"। FightAging.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১১-২৩।